হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এরশাদ করেন, ধ্বংসকারী সাতটি কাজ হতে তোমরা বিরত থাক। সাহাবীগণ আবেদন করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! সেগুলো কি কি? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এরশাদ করলেন,
মহান আল্লাহর সাথে শিরক করা অর্থাৎ,সত্তাগতভাবে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা
যাদু করা,
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, তবে শরীয়ত মোতাবেক হত্যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নিরিখে বৈধ
সুদ খাওয়া
ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা
যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা
সতী-সাধ্বী ও উদাসীন মুসলিম নারীদের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া।
[বুখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে মিশকাত শরীফ ১৭ পৃষ্ঠা]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
একজন মানুষের জন্যে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি তার ঈমান-আক্বীদার হেফাজত করা তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। অপর এক হাদিসে ধ্বংসকারী চরিত্রের সংখ্যা ১৭টি বলা হলেও মূল বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে অভিন্নতা।
সুতরাং ওই হাদিসে বর্ণিত ১৭টি বিষয়ের মধ্যে ৪টির সম্পর্ক অন্তরের সাথে। ১. শিরক ও কুফর, ২. গুনাহর ওপর অটল থাকা, ৩. রহমত হতে হতাশ হওয়া, ৪. আল্লাহর শাস্তি হতে নির্বিঘ্ন থাকা। পরবর্তী চারটির সম্পর্ক মুখের সাথে : ১. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, ২. ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া, ৩. ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা কসম করা, ৪. যাদু করা।
এর পরবর্তী তিনটির সম্পর্ক পেটের সাথে, ১. মদ্যপান, ২. ইয়াতিমের সম্পদ হরণ, ৩. সুদ খাওয়া।
পরবর্তী দুটির সম্পর্ক হাতের সাথে, ১. অন্যায়ভাবে হত্যা করা, ২. চুরি করা।
পরবর্তী একটি পায়ের সাথে সম্পর্কিত, ১. কাফিরগণের সাথে যুদ্ধের ময়দান হতে ফিরে আসা। সর্বশেষ চরিত্র সমগ্র শরীরের সাথে। আর তা হলো, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া এবং তাদের সাথে বেয়াদবী করা।
১. মহান আল্লাহর সাথে শিরক করা
মহান আল্লাহ্ অনাদি এবং অনন্ত। তাঁর কোনো শুরু নেই এবং শেষও নেই। তিনি স্বয়ং স্রষ্টা। কেউ তাকে সৃষ্টি করেনি। সত্তাগতভাবে তিনি সকল বস্তুর স্রষ্টা ও মালিক। তিনি যেমন অবিনশ্বর তেমনি তাঁর গুণাবলীও অবিনশ্বর। সুতরাং সত্তাগতভাবে অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা শিরক। পক্ষান্তরে তাঁর কতিপয় গুণ বা গুণবাচক নাম তাঁর প্রিয় নবী অথবা প্রিয় বান্দার জন্যে ব্যবহার ইসলামী পরিভাষায় লক্ষ্য করা যায়। এমনকি পবিত্র ক্বোরআনেও পরিলক্ষিত হয়, এটা শিরক নয়। কারণ ওই সব গুণবাচক নাম কিংবা গুণাবলী আল্লাহ্ প্রদত্ত, সত্তাগত নয়। যেমন- রহীম, আযীয, রউফ, করীম ইত্যাদি। এগুলো যেমনিভাবে আল্লাহর গুণবাচক নাম, তেমনি রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এর জন্যেও ব্যবহৃত হয়। কিছু লোক ‘ইয়া রসূলুল্লাহ্’ ‘ইয়া শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী’ ইত্যাদি বলাকে শিরক ফতোয়া দিতে থাকে। তাদের ধারণা দূরবর্তী কাউকে ডাকা শিরক। না’উযুবিল্লাহ!
দূরবর্তী কাউকে ডাকলে যদি শিরক হতো তাহলে, স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা কেন হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ইব্রাহীম কে শিরক শিক্ষা দেবেন? যেমন,এরশাদ হচ্ছে “ওয়া আয্যিন ফিন্ না-সি বিল্ হাজ্ব'” অর্থঃ তুমি মানুষের কাছে ঘোষণা দিয়ে দাও। যে সমস্ত লোকদেরকে সেদিন হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ আলাইহিস সালাম আহ্বান করেছিলেন, তারা কেউ কাছে ছিলো না; বরং পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিলো। সুতরাং পবিত্র কোরআনই প্রমাণ করে দিলো, দূরবর্তী কাউকে ডাকা শিরক নয়।
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ”হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা ! আপনি বলুন! হে লোকেরা! আমি তোমাদের সকলেরই কাছে আল্লাহর রসূল হয়ে প্রেরিত।” এখানেও গায়েবী ডাক দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। নামাজের প্রথম বৈঠক ও শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের মধ্যে ”আস্ সালামু আলাইকা ইয়া আইয়ুহান্ নাবিইয়্যু …” বলা হয়,যার অর্থঃহে নবী ! আপনাকে সালাম… । এতেও কি তাদের মতে শিরক হবে? তারা এ বাক্য দিয়ে নবীকে দূর থেকে সালাম দেয়, নাকি কাছে থেকে সালাম দেয়। যদি বলে কাছে থেকে সালাম দেয়, তাহলে তারা মেনে নিলো নবী হাজির-নাজির; যা তাদের ভ্রান্ত আকীদা মতে নাজায়েজ। আর যদি বলে দূর থেকে সালাম দেই। তাহলে তো মারাত্মক। অর্থাৎ নিজের ফতোয়ায় নিজে মুশরিক তথা শিরককারী হয়ে গেলো!
২. যাদু করা:
যাদু শিক্ষা এবং যাদুর মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দেয়া উভয়টিই হারাম। এটা শয়তান এবং কাফিরদের কাজ।নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা এরশাদ করেন, “যে যাদু করে এবং যে অন্যকে দিয়ে যাদু করায়, তারা আমার উম্মত নয়।” ইমাম মালিক রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, যাদুকারী কাফির।
৩. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা :
অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা চরম অপরাধ। পবিত্র ক্বোরআনে এর শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নামের আযাবও বলা হয়েছে।
৪. সুদ খাওয়া :
ক্বোরআনে করীমের দলিল মোতাবেক সুদ খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। একথার অস্বীকারকারী তথা সুদকে হালাল মনে যে খায় সে কাফির। এছাড়া সুদের কতিপয় খারাপ দিক রয়েছে। সুদখোরের অন্তরের কোনো ধরনের মমতা থাকে না, সাম্য-মৈত্রীর কোনো প্রভাবই তার অন্তরে থাকে না। এরা কোনো প্রয়োজনীয় কাজেও টাকা ব্যয় করে না। এরা যাকাত আদায় করে না। অনুরূপভাবে দান-সাদকার নিকটেও যায় না। সুদখোরের বিরুদ্ধে আল্লাহ্তায়ালা ইরশাদ করেছেন- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের অবশিষ্ট সম্পদ ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ্ এবং রসূলের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। – [সূরা বাক্বারা]
৫. ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা :
ধ্বংসকারী চরিত্রের আরেকটি হলো ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন- “নিশ্চয় যারা ইয়াতীমের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলে তারা যেনো আগুন দ্বারা নিজেদের পেট পূর্ণ করলো এবং অচিরেই নিশ্চয় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
৬. যুদ্ধের ময়দান হতে ফিরে আসা :
কাফির-বেদ্বীনদের জুলুম-অত্যাচার হতে ইসলাম ও মুসলমানকে রক্ষা করার জন্য জিহাদ করা ফরজ। এ ধরনের ফরজ জিহাদের ময়দান হতে কেউ কাপুরুষের মতো পালিয়ে আসা মারাত্মক অপরাধ এবং এটা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
৭. সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়া :
সতী-সাধ্বী ও উদাসীন মহিলাদের প্রতি যিনা তথা ব্যাভিদচারের অপবাদ দেয়া কবীরা গুনাহ।
পরিশেষে মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে উল্লিখিত ধ্বংসাত্মক সাতটি খারাপ চরিত্র হতে হিফাজত করুক, আমিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন